বৃক্ষদের প্রাতঃস্মরণীয় বিপ্রদাশ বড়ুয়া |
সেই ১৯৯২ সালের বসন্তে কদম ফুল ফোটা দেখে প্রকৃতি দেখায় আরও সতর্ক ও উৎসাহী হয়ে উঠলাম, সাথে ঢাকার কার্জন হলের বিশাল মাদার গাছে সাদা মাদার ফুল ফুটে আছে দেখে আরো অনুসন্ধানী হয়ে উঠলাম। আর সাথে সাথে ‘দৈনিক বাংলার’ প্রথম পৃষ্ঠায় রিপোর্ট লিখলাম। সে কি উত্তেজনা আমার। রিপোর্টটির নাম ছিল ‘বসন্তের কদম ও সাদা মাদার।’
এ সময় গাছদের প্রাতঃস্মরণীয় শ্রীদ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইটির প্রতি নতুন করে আশ্লিষ্ট হয়ে পড়ি। ৮০টি গাছ সম্পর্কে ঝকঝকে সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক বিবরণ নাকি বিশ্লেষণ! অথবা অনুসন্ধান! কিংবা তুলি দিয়ে কথামালার সচিত্রকরণ! বইয়ের সব গাছ তখনো চিনি না। বুদ্ধ নারিকেল আবার কেমন ধারার গাছ? তখনই মনে প্রশ্ন জাগে পেল্টোফরামকে ‘হলুদ কৃষ্ণচূড়া’ বলবে কেন? স্বর্ণচূড়া বা হলুদচূড়া নাম দিলেই তো হয়ে যায়। আমি এই নামেই তাদের ডাকতে থাকি। ঐ সুউচ্চ গাছের তলায় গিয়ে টুপি পড়ে যাওয়ার মতো করে ওর দিকে মাথা পেছন পানে হেলিয়ে চোখ তুলে দেখে দেখে ডাকতাম। কথা বলতাম।
দ্বিজেনদার সাথে পরিচয়, খুব নিশ্চিত যে, বন্ধু হায়াৎ মামুদের ঘরে অথবা তেমন কোনো পরিবেশে। দ্বিজেনদা হয়তো বলেছিলেন, ‘বিপ্র, আমার ঘরে আসিও।’ এতো সুন্দর গদ্য যিনি লেখেন, নির্ভুল যার কাব্যিক-গদ্য রচনা, তিনি বললেন, ‘বিপ্র, আসিও।’ তখনও সেই দ্বিজেনদাই আছেন, চুল পেকে সাদা ফুরফুরে হয়ে গেছে, তেল দেন বলে মনে হয় না, অমলিন হাসি দিলে চোখ দুটি একটু ছোট হয়ে যায়, ইচ্ছে করে না হাসলেও দেখা হলেই মুখে তার স্পর্শ কখনো মুছে যায় না। ভাঙা সুরেলা কণ্ঠস্বর এতোই তাঁর নিজস্ব যে, সুঅন্ধকারেও বটবৃক্ষ চেনার মতো তাঁকে অভ্রান্তভাবে চিনে নিতে কখনো ভুল হওয়ার উপায় নেই। সবার থেকে একেবারেই তিনি আলাদা।
তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গে’ পাদাউক গাছের বর্ণনা পড়ে আমি তো আর চট্টগ্রামে বসে গাছটি চিনতে পারি না। তৃতীয় দফায় ঢাকায় যখন স্থায়ী ডেরা পাততে এলাম তখন প্রধান ডাকঘরের দ্বিতীয় গেটের দ্বিজেনদার বর্ণনার গাছটি নেই। সেটা ১৯৭৬ সাল, ঢাকার রাস্তার পাশের বিখ্যাত ও প্রায় শতবর্ষী গাছদের খুন করার বছর তখন শুরু হয়ে গেছে সামরিক সরকারের হাতে। শাহবাগের বিখ্যাত কৃষ্ণচূড়া বীথি, রমনা পার্কের পশ্চিম পাশের অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধার মতো সেগুনসারি, নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিকের বড় বড় বৃক্ষ একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে। প্রধান ডাকঘরের দক্ষিণ দিকের বা কাকরাইলের মোড়ের বিখ্যাত বয়স্ক বৃক্ষ দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। হাইকোর্টের সামনের রাস্তা বড় করার নামে ফুটপাতের বিখ্যাত অশ্বত্থ-পাকুড় গাছগুলোর শেকড়ের দিকে পরিকল্পিত দৃষ্টি না দিয়ে তাদের সর্বনাশ করে চলেছে। আজ সেখানে মাত্র কয়েকটি গাছ আছে। অবশিষ্ট কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরি থেকে ছাঁটাই হওয়ার মতো কোনো মতে টিকে আছে, আর প্রায় প্রত্যেক কালবৈশাখির ঝড়ে একটা ভেঙে বা ভেঙে উপড়ে পড়বেই।
দ্বিজেনদার বর্ণনা অনুযায়ী হেয়ার রোডের দু পাশের পাদাউক গাছের দিকে গত শতাব্দীর শেষের দশকে গরমকাল এলেই চোখ রেখে চলেছি। অবশেষে একদিন পেয়ে গেলাম দুপুরের দিকে। মতিউর রহমান তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক। আমি সে পত্রিকার প্রকৃতি বিষয়ক রিপোর্টার। না, চাকরিসূত্রে নয়, মতি ভাই আমাকে ঐ পদহীন পদে আবৃত করেছেন। আমি নিয়মিত সেখানে প্রকৃতির শোভা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ বন্ধু, গাছপালা-তরুলতা-ফুল ইত্যাদি হরেক বিষয় নিয়ে লিখি। ফোন দিলাম মতি ভাইকে। চলে এলো শামসুল হক টেংকুু। ওর টেলিলেন্স দিয়ে ছবি তুললো, আমার ক্যামেরা নেই তখন। পরদিন কাগজে উঠলো লেখা, পাঠকদের বলে দিলাম যে ছবি দেখে ঐ ফুল দেখতে গেলে হতাশ হতে হবে। কারণ পদাউকের সোনা রঙের ফুলের আয়ু মাত্র একদিন। পরদিন বা পরে অন্য গাছের ফুল ফুটলে শিকারি বা অনুসন্ধানী পাঠকরা পদাউক ফুল দেখতে পাবেন। আরো পরে ২০০১ সালে মে মাসে মিয়ানমার গিয়ে পদাউকের ফুল ফোটা দেখি। সেখানে এর নাম সেন্না গাছ, ইংরেজিতে বলে বার্মিজ রোজ-উড, সেন্না ট্রি। দ্বিজেনদা ছাড়া কে আমাকে এর প্রতি অনুসন্ধিৎসা, আবেগ ও ভালোবাসা পাঠ দিতেন? এমন মমতা দিয়ে আর একজন ভৈষজবিদ গাছপালা সম্পর্কে ১১ খণ্ড বই লিখেছেন, তাঁর নাম শিবকালী ভট্টাচার্য। বইটির নাম ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’। প্রকৃতি বিষয়ে আমার যতো বিদ্যা তার অবৈতনিক ও পাঠশালা বর্হিভূত শিক্ষক হলেন এরা দু’জন। আমার ছেলেবেলার শিক্ষক গ্রামের সু-সুবিশাল ভিটের কথাও আমি ভুলবো না।
আণবিক শক্তির অফিসের সামনে একটি আকরকণ্ট গাছ আছে। ফজলুল হক হলের উলটোদিকে রেলের জায়গায় দেয়ালের ভেতরে, এক সারি এই গাছ ছিল। করপোরেশন বা নগর ভবনের উত্তর পশ্চিম কোণে দুটি গাছ আছে (এ বছর আছে কি না দেখা হয়নি।) বসন্তকালে পাতাহীন গাছে ফুল সাদায় সাদায় মাতাল হয়ে থাকে কুর্চির মতো। আকরকণ্টের আরেক নাম বাঘ আকর। শিবকালী ও দ্বিজেনদার বই ছাড়া কার কাছে এর পরিচয় পেতাম। আমিও অক্লান্ত লিখে চলেছি ভোরের কাগজের শেষ পাতায় আশ্লেষ সুখে, সেই ১৯৯৫ থেকে নিয়মিতভাবে শুরু। এখন এসব নিয়ে বইয়ের সংখ্যা দশটি।
কুর্চি প্রথম দেখি খুব সম্ভবত শান্তিনিকেতনে। শ্যামলী নিসর্গে বর্ণনা পড়ে খুঁজে পাই বন্ধু মফিদুল হকের বাড়িতে, বলধায়, বঙ্গভবনের সামনের উদ্যানে, প্রধান বিচারপতির বাসার উত্তর দিকে রাস্তার ধারে, কবি নজরুল ইসলাম এভিনিউর পরীবাগ এলাকায় রাস্তার দু পাশে দুটি (এখন একটিও নেই, বহুতল বাড়ি নির্মাণের জন্য কেটে সাফ), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী বাগানে রোয়া গাছটিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে হুমায়ুন আজাদ ও হাশেম খান যেখানে থাকেন ও থাকতেন সেখানে দুটি গাছে। কুর্চি বাংলার বনজঙ্গলের গাছ। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির টিলা ও পাহাড়ে হাঁটু সমান গাছেও অজস্র ফুটতে দেখেছি। অথচ নগরে কুর্চি দুর্লভ। এসব কথা শ্যামলী নিসর্গ ছাড়া আগে কোথাও পাইনি এতো সহজে। আর এখন আমি ওকে ফুটতে দেখি মনের চোখে, সুন্দর খোঁপায় ফুলদানিতে বুদ্ধদেব বসু অনূদিত কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে পড়েছি ১৯৬৫ সালে।
সিলভার ওক, ক্যাশিয়া, গ্লিরিসিডিয়া, মিলেশিয়া, অ্যালবিজিয়া বেরিয়া, তেলশুরের বর্ণনা পড়ে চিনেছিÑ শ্যামলী নিসর্গ ছাড়া আর কে চেনাবে? দ্বিজেনদা তখন মস্কো-ঢাকা করছেন। বিজ্ঞানের বই অনুবাদ করছেন অসাধারণ অনুরাগে। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনার বিখ্যাত সব বই, পরে হায়াৎ মামুদ গিয়ে যোগ দিলেন। তাঁদের মুখে শুনতাম ননী ভৌমিকের কথা। হায়াৎ ননীদাকে নিয়ে এখনও কাজ করছেন। দ্বিজেনদা এখনও মাঝে মধ্যে মস্কোতে যান, এখনও তাঁদের অনুবাদ করা অসাধারণ সব বই দ্বিতীয়, তৃতীয়বার পড়ি অথবা দেখি।
ও দ্বিজেনদা, আপনাকে না বলে মাঝে মধ্যে অপকম্মো করে ফেলি। ঐ যে ক্যাশিয়ার নাম রেখেছি বসন্ত রঞ্জিনীর; পেল্টে ফরামের নাম স্বর্ণচূড়া ও হলুদচূড়া; গ্লিরিসিডিয়া ম্যাকুইলেটার নাম ফাল্গুনি মঞ্জুরী; মিলেশিয়ার নাম চৈতি মঞ্জরী। কী করবো ওদের ফুল এতো সুন্দর যে, যে ঋতুতে ফোটে তার সাথে বা বাংলা মাসের সাথে যোগ করে না দিয়ে পারলাম না। কেউ মানুক না মানুক, আমি ডাকবো, প্রিয়জনদের আমরা নতুন নাম দেই না?
‘ফুলগুলি যেন কথা’ বইটি প্রথম ছাপা কপি তো আমার আছেই। দ্বিতীয় সংস্করণও কিনেছি। প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৩ সাল। নতুন সংস্করণ ছবিতে ছবিতে আকুল। শুধু ছবি দেখলেই মন ও হৃদয় জুড়িয়ে যায়। আমি জানি মূল ছবির সাথে বইয়ের ছবির রঙের পার্থক্য আছে। তবুও বুঝতে কোনো অসুবিধে আমার হয় না। সুষমা বা ব্রনফেলসিয়া ও অঞ্জনের রঙের জৌলুস বইতে আসেনি। চার রঙে আসা সম্ভবও নয়। অন্তত পাঁচ-ছয় রঙে ছাপা হলে মূলের কাছাকাছি রঙ পেতাম। অপরাজিতা বা কদম কোনোটির যথাযথ রঙ না পেলেও চিনতে অসুবিধে হয় না। একসঙ্গে এতোগুলো ফুল পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এরকম একটি বিদেশি বই কিনতে হলে কতো টাকা চলে যেত।
দ্বিজেনদা আমাদের পথিকৃৎ গাছপালাকে সাধারণের পাঠ্যসামগ্রী করার জন্য। তাঁর নির্ভার সহজবোধ্য ও উপলমুখর গদ্য আমাদের টেনে ধরে রাখে। নতুনদের গদ্যনির্মাণকলা শেখায়। তার মাঝে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তরুলতার ব্যবহারে ছোট একটি তালিকা পাঠকদের আকুল করে দেবে, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী করে তুলবে। রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল তারপর আমরা পাই জীবনানন্দ দাশকে বাংলার গাছ, ফুল, পাখির ভাণ্ডার মেলে ধরার জন্য। আধুনিককালে কবিরা তেমন করে গাছপালা, তরুফুল ও পাখির দিকে হাত বাড়াতে চান না, সম্ভবত সেভাবে চেনেনও না। আমাদের দীনতার এই দিকটি দ্বিজেনদার বৃক্ষচর্চায় ধরা পড়েছে। তিনি কোথাও হয়তো বলেননি; কিন্তু না বলার মধ্যেও অনেক বলা থাকে তা আমরা জানি। এমনকি একজন কথাসাহিত্যিকের উপন্যাসেও পাওয়া যায়Ñ রাতের নাম না-জানা পাখি ডেকে গেলÑ বর্ণনার কিছুই নেই, অথচ উপন্যাস তা দাবি করে। এই প্রসঙ্গ এখানেই থামিয়ে দিলাম।
ফুলগুলি যেন কথা বইতে ৩৬৬ ফুলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। সাধারণ পাঠকের চেনার জন্য এই-ই যথেষ্ট। কোনো সমস্যায় পড়লে প্রথমে এই বই দেখি। তারপর দ্বিজেনদার ফোন তো আছেই।
শিশু একাডেমীতে প্রায়ই তিনি আসতেন। ফেরার পথে যেতেন সোহরাওয়ার্দি ও রমনা পার্ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। কতোবার তাঁর সাথে ঢাকার ফুসফুস-দুটি দেখেছি। রমনা পার্কের পারুল ও বাওবাব আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। দুটি পারুল গাছের একটিও এখন নেই, মরে গেছে। তিনটি বাওবাব আছে। দ্বিজেনদা বললেন ধানমন্ডি লেকের পাড়ে অন্য বাওবাবটি আছে, ওখানে তেলশুর আছে, সেখানে ক্যামেলিয়া আছে।
একদিন সোহরাওয়ার্দি দিয়ে যেতে যেতে, এক বসন্তে, তিনি বললেনÑ ‘বিপ্র, দেখো, অশোক ফুলটি অন্য রঙের। এমন রঙ তুমি কোথাও পাবে না। এর লাল ভাবটা একটু কম। তুমি এর ডাল থেকে কলম করলে এই রঙটি ঠিক ঠিক পাবে। বীজ থেকে চারা করে গাছ করলে এই রঙ না-ও পেতে পারো।’
রমনায় দুটি তমাল আছে। দ্বিজেনদা সিলেট থেকে একটি চারা এনে দিলেন, কড়ে আঙুলের সমান ছোট। সেটি শিশু একাডেমীতে রুয়ে ছায়া দিয়ে মাথা সমান বড় করেছি। আমি একাডেমী ছেড়ে আসার পর একাডেমীর চেয়ারম্যান ফুলের বাগানে শাকসবজি রোয়ার আদেশ দিলেন। মালি সালউদ্দিনও না পারতে শিমলতা তমাল গাছে তুলে দেয়। তাকে তো চাকরি বাঁচাতে হবে। বেগুন, ঢেঁড়শ, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি ফললো, যেন এতে বাংলাদেশে শাকসবজির অভাব পূরণ হয়ে যাবে। শেষে জানালাম এগুলো নিজে এবং মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কাকে কাকে ভেট দেন তিনি। একদিন শিমলতার ভারে তমালটি মাঝখানে ভেঙে পড়ে গেল। তমালগাছটি এখনও হিজল গাছের মতো বাটুক ঝোপাল হয়ে আছে।
একটি সাদা পারুলের চারা এনে দিলেন সেই সিলেট থেকে। গাছটিতে দু বছর হলো ফুল ফুটছে। শিশু একাডেমীর বাগানটি করার জন্য আমি তার অকুণ্ঠ ও দৈহিক শ্রম পেয়েছিলাম। তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা বা ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদেও কিছু সুন্দর সুন্দর গাছের সমাবেশ তিনি করেছেন। নিজের হাতে পানি দেয়া ও পরিচর্যার ফলে ছোট বাগানটি হয়ে আছে মর্তের স্বর্গ।
সোহরাওয়ার্দির উদ্যানের সেই অশোক বীথি নেই, নেই সেই হিজলের দুটি সারি। নীলি লাজুলী বা জাকাওটিও নেই। ঢাকার একটি ফুসফুল সোহরাওয়ার্দি এখন ইট-সিমেন্টে স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি কমপ্লেক্স হচ্ছে। উদ্যান ধ্বংস করে একদিকে হয়েছে শিশুদের বিনোদন পার্ক, অন্যদিকে স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি কমপ্লেক্স। আমি ভাবতে পারি না কেন এই ফুসফুস বিধ্বংসী মনোভাব।
এখন রমনা পার্কের ছোট লেকটির উপর দেয়া হচ্ছে সেতু। অথচ প্রস্তাবিত সেতুর গোড়া থেকে লেকের উত্তর মাথা মাত্র ২০০ কদম। পার্কে গিয়ে যারা ২০০ কদম হাঁটতে পারবেন না তারা বসে বসে, একটু এদিক-ওদিক হেঁটে ফিরে আসবেন জানি। ইট-সিমেন্টের জঞ্জাল পার্কে কম থাকা উচিত বলেই তো জানি। এভাবে ঢাকার দুটি ফুসফুস একদিন হারিয়ে যাবে ইট-সিমেন্টের অরণ্যে, সেই অরণ্যে গাছ হয়ে যাচ্ছে অপ্রধান। পার্ক অথচ তার ভেতরে রাস্তা, বসার জায়গা, প্রাতর্ভ্রমণকারীদের বসার জন্য পাকা বিশ্রামঘর সব হচ্ছে। থাকবে না শুধু গাছ।
আমি জানি দ্বিজেনদাও এই মত পোষণ করেন। এজন্য এখন রমনা পার্কে যেতে ইচ্ছে করে না। দ্বিজেনদারও বয়স হয়ে যাচ্ছে, বুড়ো গাছের মতো ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি কমে যাচ্ছে। আমি তাঁর পেছন পেছন আসছি। রমনা পার্কে দুটি বিখ্যাত অর্ধ-শতবর্ষী কেয়া ঝোপ দিনে দিনে পার্ক কর্তৃপক্ষ কেটে শেষ করে ফেলেছে। বিখ্যাত মালতী গাছটি কেটে ফেলেছে। এসব বিষয়ে দ্বিজেনদার সাথে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা যায়। কিন্তু বৃক্ষদের প্রাতঃস্মরণীয়ের কথা মানুষ কেন শুনবে!
কতোদিন আপনার সাথে ঘরে বসে আড্ডা দেয়া হয় না দ্বিজেনদা! কতোদিন আপনার সাথে বলধা, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দিতে যাওয়া হয় না। শিশু একাডেমীর ‘গাছের কথা ফুলের কথা’ বইটি আপনার লেখা চমৎকার একটি বই। শিশুদের প্রতি আপনার ভালোবাসার জয় হোক।
শ্যামলী নিসর্গ, ফুলগুলি যেন কথা এবং গাছের কথা ফুলের কথা বই তিনটি বাংলা ভাষায় পথিকৃৎ নিসর্গ-ভালোবাসার বই। প্রথম দুটি বই দু’ বার মুদ্রিত হয়েছে, পরের বার দুটিরই বর্ধিত সংস্করণ হওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব ধনবান হয়েছি।
আবার একই কথা যা বারবার বলতে পারি, নিসর্গ বিষয়ক এই বইগুলো আমাদের প্রকৃতি অনুসন্ধানীদের জন্য এবং বাংলা ভাষার পথিকৃৎ রচনা। আম-জাম-গর্জন-তেলশুর-চাপালিশ-বট-অশ্বত্থ-জারুল-শালবৃক্ষের মতো শ্রীদ্বিজেন শর্মা, আমাদের দ্বিজেনদা মহীরুহ-মহাদ্রুম হয়ে থাকুক। বৃক্ষদের প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে তো আছেনই।
লেখক : সাহিত্যিক ও প্রকৃতিবিদ