স্যার ও আমি এবং কিছু সুখস্মৃতি

সুধীর কুমার দত্ত

১৯৫৮-এর মাঝামাঝিপ্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বের হয়েছে কোথায় পড়বো ঢাকা না বরিশাল এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থবরিশাল বাড়ির কাছে এই ভেবে শেষমেষ বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হইকলেজটির পরিচিতি নি®প্রয়োজনঅতি প্রাচীন বিদ্যাপীঠএককালে অক্সফোর্ড অফ দ্য ইস্ট নামে খ্যাতক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্রাবাসভর্তি হলাম সেখানেওক্লাস শুরুর পঞ্জিকা মনে নেই তবে প্রথম দিনের আইএসসি ক্লাসের রুটিনে জীববিদ্যার ঘরে উ.ঝ-এর নামউ.ঝ মানে দ্বিজেন শর্মাপুরো নামটি দাদাদের কাছ থেকে উদ্ধারজীববিদ্যা ক্লাসের ঘণ্টা পড়লো ক্লাস রেজিস্টার, চকের বাক্স, ডাস্টার ইত্যাদি নিয়ে যিনি প্রথম ক্লাসে ঢুকলেন তিনি গিরীন্দ্রদাÑ আমাদের জীববিদ্যা পরীক্ষাগারের কর্মচারীপেছনেই একগাদা বই হাতে উ.ঝবয়সে নবীনচোখেমুখে ব্যক্তিত্বের ছাপগাম্ভীর্যও উপেক্ষা করার মতো নয় আমরা দাঁড়াতেই ইশারায় বসার ইঙ্গিততারপর নাম ডাকা আর পরিচয়ের পালা বাকি সময়টা জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং সে সবের গুরুত্ব আলোচনাক্লাস শেষঐ দিনই স্যারকে প্রথম দেখা ও জানা, যে জানা আজও ফুরায়নি

আমাদের ছাত্রাবাসের মধ্যে একটি বাসায় তিনি থাকতেন, কলেজ থেকে বরাদ্দ করাসাজ-সজ্জার মধ্যে উল্লেখ্য বইপত্রে ঠাসা একটি আলমারি, টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত বই ও জার্নাল, আঙ্গিনায় লতাগুল্মের একটি ছোট্ট বাগান আর খাঁচাবন্দী কিছু মুনিয়া পাখিবাগানে ছিল নজরকাড়া কয়েকটি আশ্চর্য সুন্দর জাতের গোলাপদেখতে ভিড় জমাতেন অনেকেইএমনকি বরিশাল ডগলাস বর্ডিয়ের সাহেবরাওআমাদের ছাত্রবাসের পুকুরটিও তার কল্যাণে নানা জাতের শাপলা, পদ্ম ইত্যাদি দৃষ্টিনন্দন জলজ ফুলে ভরে থাকতো

স্যার যেমনি কঠোর পরিশ্রমী তেমনি নিয়মানুবর্তীভোরে প্রাতঃভ্রমণ, যথাসময়ে কলেজ, ক্লাস শেষে বাসা, স্নানাহার, বিশ্রাম, বিকেলে বাগান পরিচর্যা, সন্ধ্যায় কলেজের মাঠে সহকর্মীদের সাথে খেলাধুলা ইত্যাদি ইত্যাদিব্যতয় বড় একটা চোখে পড়েনিস্যার একটি কুকুর পুষতেননাম টমিপ্রভুকে যেমন ওর চোখ এড়াতো না, স্যারও ওকে যথেষ্ট আদর করতেনঐ সময় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের মেয়াদ শেষ হলে স্যার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেনফলে আমরা তাকে বেশি করে জানার সুযোগ পেলামমাত্র তিনজন ছাত্রÑ অরবিন্দ, শৈলেন ও শামসুদ্দিনকে নিয়ে তিনি প্রথম বিএম কলেজে স্নাতক বিজ্ঞানে উদ্ভিদবিদ্যা চালু করেনজাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষফলে সহযোগিতার কোনো অভাব হয়নি কলেজের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্যার তখন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, তাই তার প্রতি অধ্যক্ষের সুনজর ছিল সব চাইতে বেশি

বিএম কলেজের জীববিদ্যার পরীক্ষাগার আধুনিকীকরণ এবং নতুন করে স্নাতক উদ্ভিদবিদ্যার একটি পরিপূর্ণ পরীক্ষাগার নির্মাণ তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের সুফলএখানে একটি উদ্ভিদ জাদুঘর ও একটি শুষ্ক উদ্ভিদ সংগ্রহশালাও (হার্বেরিয়াম) রয়েছেবরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলের সব দুর্লভ উদ্ভিদ নমুনা দ্বারা ঐ সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ করা হয়েছিলস্যার কাজের অবসরে, ছুটির দিনে স্নাতক উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস নিতেন তার বাসার আঙ্গিনায়কখনও বিদ্যুতের আলোয় চা-চক্র ও পাঠদান চলতো যুগপৎগুরুশিষ্যের এতো মধুর সম্পর্ক আমাদের মুগ্ধ করতোস্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষায় ঐ তিনজন শিক্ষার্থীর একজন অরবিন্দ দাস সম্মানজনক স্থান লাভ করে ১ম বিভাগে এবং বাকি দুজন শৈলেন সিকদার ও শাসসুদ্দিন আহমেদ ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন

কলেজ চত্বরে উদ্ভিদ উদ্যান ও বৃক্ষায়ণ পরিকল্পনায় স্যার এমনই বিচক্ষণ ছিলেন যে, উদ্ভিদবিদ্যা পড়য়াদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত সব উদ্ভিদ চেনা ও ব্যবহারিক ক্লাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মোটেই ভাবতে হতো নাকলেজের মধ্যবর্তী হিন্দু-মুসলিম ছাত্রাবাসের বাগানের নকশা, মৌসুমী ও ঋতুসহিষ্ণু ফুল গাছ চাষাবাদের কৌশল তিনি মালিদের বাতলে দিতেনভূদৃশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে কলেজ থেকে দুই ছাত্রাবাসের সম্মুখের দুই দীঘি সংলগ্ন রাস্তার দুধারে পর্যায়ক্রমে যেসব দৃষ্টিনন্দন ফুলেল গাছ ও চিরসবুজ ছায়াতরু রোপণ করেন তা আজও দর্শকদের নজর কাড়ে

স্যার তত্ত্বাবধায়ক থাকাকালীন সময়ে ছাত্রাবাসে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমাদের বাধ্যতামূলক ছিলতিনি নিজেই এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেনরবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী, শিক্ষা সপ্তাহ, লাইব্রেরি সপ্তাহ, ক্রীড়া কৌতুক, পূজো পার্বণ, বিতর্কসভা ইত্যাদি কোনোকিছুই বাদ যেত নাআমাদের যেকোনো অর্থবহ কাজে তাঁর উৎসাহের ঘাটতি দেখিনিএকটি ঘটনার উল্লেখ এখানেই নিতান্তই অপরিহার্যআমি সরস্বতী পূজো কমিটির সম্পাদক পূজোর নিমন্ত্রণপত্রে কি লিখবো আকাশ-পাতাল ভেবে অস্থিরশেষমেষ স্যারের দ্বারস্থসভয়ে সমস্যার কথা বললামআমাকে বসতে বলে টেবিলের ওপর থেকে প্যাড নিয়ে লিখতে শুরু করেনআমি স্মৃতি-বিস্মৃত না হলে লেখাটা এই ছিলÑ ‘জ্ঞান অন্বেষার ইতিহাস সভ্যতার মতোই সুপ্রাচীন, কোন সুদূর অতীতের যে ধুসরময় প্রদোষে তপমগ্ন ঋষিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল আলোর আকণ্ঠ পিপাসা তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানেবাণী বন্দনা মানব সত্তার সেই চিরন্তন অন্বেষারই প্রতীকহে সুধী! আপনার শুভাগমনে...কাগজটা হাতে নিয়ে রুমে ফেরার পথে ভাবলাম এতো অল্প সময়ে, এতো অল্প কথায় এতো সুন্দর করে স্যার ছাড়া আর কে লিখতে পারেন! ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কারের বাইরে থেকে চিন্তা শক্তির এই অন্তর্ভেদি মৌলিকতা আমাকে বিস্মিত করেএখনও লিখতে গিয়ে কিছু মিলাতে না পারলে স্যারের শরণাপন্ন হইকখনও টেলিফোনে, কখনও বাসায় গিয়েসত্যিই এক আশ্চর্য জ্ঞানকোষ মনে হয় তাঁকে

আইএসসি পড়া শেষে বিএম কলেজেই উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হইফলে স্যারের নৈকট্য লাভের বেশি সুযোগ হয়তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি সংক্ষিপ্ত ও ব্যতিক্রম ধর্মীপাঠ্যসূচির বাইরেও বিজ্ঞানের অনেক অজানা তথ্য তিনি আমাদের বলতেনতাঁর আরেকটি বিশেষত্ব জোর করে আমাদের কিছু শেখাবার চেষ্টা করেননিইংরেজি বাক্যে বিষয়টিকে অল্প কথায় বোধহয় আরও গুছিয়ে বলতে পারবোÑ ‘ঞবধপযরহম, মঁরফরহম ধহফ    পড়ৎৎবপঃরহম ৎধঃযবৎ ঃযধহ পড়হঃৎড়ষষরহম’, এ সত্যিই পাঠদান পদ্ধতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্যশিক্ষকতাকে তিনি জীবনের এক মহান ব্রত রূপেই আত্মস্থ করেনতাই শিক্ষক ছাত্র সম্পর্কটাকে কর্মজীবনে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেনশুধু উদ্ভিদেরই নয় সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীই তার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য ছিলতার প্রজ্ঞা, আদর্শ ছাত্রদের মুগ্ধ করতোতার সান্নিধ্য লাভে তারা সর্বদা উন্মুখ ছিলতাই সময়-অসময়ে ভিড় জমাত তাঁর বাসায়

তৎকালীন সামরিক সরকার স্যারের সাথে ছাত্রসমাজের এই সুসম্পর্ক মোটেই সুনজরে দেখেনিসরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন এবং তাতে স্যারের ইন্ধন থাকতে পারে এই আশঙ্কায় তারা স্যারকে বরিশাল জেলে আটকে রাখেস্যার এতে বিচলিত হননি বরং জেলের মধ্যে অঢেল অবসরের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি সাহিত্য চর্চায় ব্যয় করেনতিনি অসীম মানসিক শক্তির অধিকারী, তাই ধঃ বাবৎু সড়সবহঃ যব রং ংবঃঃষবফ. ওখানে তিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বই পড়ে সময় কাটাতেনকারাবাসের মধ্যেই তিনি সতীর্থ বলয়ে ডারউইন নামক তার বিখ্যাত প্রথম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেনপ্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সরকার তাদের ভুল সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে অতি অল্পদিনেরই মধ্যেই স্যারকে নিঃশর্ত মুক্তি দেনজেল থেকে বেরুনোর সময় তাঁর সাথে ছিল নানা প্রবন্ধ ও একাধিক বইয়ের পাণ্ডুলিপিঊাবৎুঃযরহম রং    বাবৎযিবৎব, নঁঃ হধঃঁৎব ংবষবপঃং’, বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করার জন্য উক্তিটি করেছিলেন জনৈক বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব (নামটা মনে করতে পারছি না, সম্ভবত ঔ.উ.ইবৎহবষ)স্যার যেন এই উক্তিরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

আমি বিএসসি ২য় বর্ষে, স্যার বিএম কলেজ ছেড়ে নটরডেম কলেজে যোগ দেনএর বছর দুয়েক আগে বরিশাল শহরের বিখ্যাত চক্রবর্তী পরিবারের দেবী চক্রবর্তীকে বিয়ে করেনঢাকা এসে তেজগাঁয়ের ফার্মগেটে নতুন সংসার শুরু করেনদেবীদি দর্শনশাস্ত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হনআমি বরিশাল থেকে স্নাতক পাঠ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিভাগে ভর্তি হইনটরডেম কলেজ ও ফার্মগেটে ছিল আমার নিয়মিত যাতায়াতস্যার বন্ধুবৎসলঢাকা আসার পর বরিশালের বন্ধুরা প্রায়শই এখানে আসতেনকেউ পড়ার জন্য, কেউবা প্রশিক্ষণ নিতেএদের মধ্যে গফুর ভাই, ইউসুফ ভাই, শশাঙ্ক অনেকদিন স্যারের বাসায় ছিলেনস্যার প্রয়াত অধ্যাপক নূরুল ইসলাম স্যারের সাথে ক্যারোফাইটা অফ বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করতেনকারা সংগ্রহের জন্য একটা মটর সাইকেল কিনেছিলেনছুটির দিন ওটির পেছনে বসে স্যারের সাথে কারা সংগ্রহে যেতামকিছুদিন পর স্যার ফার্মগেট ছেড়ে সিদ্ধেশ্বরীতে ফ্ল্যাট ভাড়া নেনজুটে গেল পল নামে একটি কাজের ছেলেওচমৎকার রান্না করতো পলহলের একঘেয়েমি খাওয়ার স্বাদ পালটাতে প্রায়ই পলের শরণাপন্ন হতাম

ক্লাস না থাকলে নটরমেড কলেজেই সময় কাটতো বেশিলাইব্রেরিতে পড়া ও ব্যবহারিক ক্লাসে স্যার ও জেমসকে সাহায্য করতে ভালোই লাগতোনটরডেম কলেজের ভূদৃশ্য অনুযায়ী কলেজ চত্বরে একটি বাগান নির্মাণের পরিকল্পনা স্যারের নিজেরইকলেজে যোগদানের পর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য অল্পদিনেরই মধ্যেই তিনি তৎকালীন অধ্যক্ষ ফাদার টিমের সুনজরে পড়েনফাদার বাগানের নকশা, উদ্ভিদ বিন্যাস পদ্ধতি দেখে এতোই মুগ্ধ হন যে সম্পূর্ণ প্রকল্পটির সার্থক রূপায়নের জন্য তৎক্ষাণৎ ফাদার বেনাসকে সবরকম সহযোগিতা করার অনুরোধ করেনস্যার অবশ্য উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ছাত্রদের ব্যবহারিক ক্লাসের প্রয়োজনীয় কিছু গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করে ইতোমধ্যে কলেজের মালি মোক্তার ভাইকে দিয়ে লাগিয়েছিলেননটরডেম কলেজের আজকের এই উদ্যান ফাদার বেনাস ও স্যারের কঠোর পরিশ্রমের ফসলস্যার বকশিবাজারে, নৈশ বাংলা মহিলা কলেজে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করতেনআমি তখন জগন্নাথ হলের পরিষদ ভবনে থাকতামতিনি প্রায়ই বিকেলে আমার রুমে আসতেনচা-পর্ব শেষে দুজনে বকশিবাজার যেতামক্লাসের পর ঘোড়-দৌড়ের মাঠে নানা গল্প-গুজবএকটু রাত হলে আমি হলে ফিরে আসতাম আর স্যার চলে যেতেন সিদ্ধেশ্বরীএমনি করে অনেক দিন আমাদের একত্রে কেটেছে

স্যার ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজেও খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেছেনদেবীদি তখন ঐ কলেজের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপককলেজের অধ্যক্ষা স্যারের অতিশয় গুণগ্রাণীতাঁরই অনুরোধে কলেজ চত্বরে একটি সুন্দর বাগান করতে গিয়ে বহু দুষ্প্রাপ্য গাছ তিনি নিজের চেষ্টাতেই সংগ্রহ করেছেনসবচেয়ে দর্শনীয় ছিল বাগানে লম্বালম্বি একসারি স্বর্ণ চাপার গাছফুল ফোটার পর চাঁপার সুগন্ধে তখন মউ মউ করতো পুরো কলেজ চত্বরস্যার ও আমি প্রায়শই কলেজের ছাদে উঠে অবাক চোখে বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতামপাখির কলকাকলি আমাদের মুগ্ধ করতোওখান থেকে আমরা আরও লক্ষ্য করতাম ঢাকা শহরের এয়ার-স্কেপহায়! সেসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি নেই সেই পাখি, নেই কুসুমে কুসুমে মঞ্জুরীত সেসব ফুলেল তরুকংক্রিটের আগ্রাসনে ভূদৃশ্য আজ পর্যুদস্তইট-বালুর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে একে একে সব সবুজের সমারোহসব উন্মুক্ত অঙ্গনবিশ্ব সাথে যোগে মিলিত হওয়ার অবকাশ কি আমাদের আছে কোথাও? নগরীর জন্য এক চিলতে নিসর্গ রমনা পার্কই এখন অবশিষ্টতাও দিন দিন সঙ্কুচিত, বিপর্যস্ত, হাজারো কর্মকাণ্ডের ভারে ন্যূব্জ

আরেকজন দুর্লভ ব্যক্তির নাম এখানে একান্তই প্রাসঙ্গিকঢাকা উদ্যান ঐতিহ্য নিয়ে তিনি আমাদের চমকপ্রদ কাহিনী শোনাতেনসেই অবিস্মরণীয় মানুষটি প্রয়াত অমৃত লাল আচার্যসত্যিই আচার্যএকজন প্রকৃত উদ্ভিদ আচার্যঅনেকদিন তিনি ঢাকার বলধা গার্ডেনের তত্ত্বাধায়কের দায়িত্বে ছিলেনউদ্ভিদান্ত প্রাণরবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় প্রথম সংবর্ধনা বলধা গার্ডেনে, কিউ বোটানিক গার্ডেনের পরিচালক প্রাউডলক কর্তৃক ঢাকা বৃক্ষায়ণ, ঢাকা হাইকোর্টের পুরনো গেটটি অবিকল ভেনিসের রাজপ্রাসাদের গেটের মতো, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (১৯৫৮) ঢাকার বৃক্ষায়ণের এতোটা সুসামঞ্জস্যতা দেখে মুগ্ধ ইত্যাদি কতো কথা তাঁর মুখে শুনতাম আর অবাক হতামঢাকার বাহারি গুল্ম নিয়ে কাজ করতে আমি প্রায়শই তাঁর কাছে যেতাম, কখনো একা, কখনো স্যারকে সাথে নিয়েঅমৃত লাল আচার্য আজ নেইবলধা গার্ডেনের সেই মাধুর্যও দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছেগোলাপের সমারোহ চিরতরে বিলুপ্ত, ক্যামেলিয়া আর ফুল ফোটায় না, শঙ্খনিধিতে রঙ-বেরঙের শাপলা ও পদ্ম আজ কারোর নজর কাড়ে না

এমএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলেজে চাকরি নিইশুরু হয় পারিবারিক জীবনওঅবশ্য এ দুটো ক্ষেত্রে স্যারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলকলেজ ছুটি হলে ঢাকা আসতামদেখা হতো তাঁর সাথেতারপর এলো মুক্তিযুদ্ধস্যার কলকাতায় চলে যানআমরা দেশেই ছিলামশুনেছি কলকাতায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তিনি আমাদের খুঁজতেনদেশ স্বাধীন হলে তিনি পুনরায় নটরডেম কলেজে যোগ দেনকিছুদিন পর পাড়ি জমান রাশিয়ান মুলুকেচাকরি নেন মস্কোর বিশ্বখ্যাত অনুবাদ সংস্থা প্রগতি প্রকাশনেদীর্ঘদিন ঐ দেশে অবস্থানকালে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন রাশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বহু দর্শনীয় স্থানেমস্কোয় ডারউইন যাদুঘর, লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেন, চেলশি গার্ডেন, কেন্টে ডারউইনের বাড়ি ইত্যাদি কিছুই বাদ যায়নি তাঁর স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানী দৃষ্টির আড়াল থেকেরাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন হলে আবার ফিরে আসেন দেশেতিনি স্বদেশকে ভালোবাসেন, তাই দেশের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা অনেকসব অর্জিত অভিজ্ঞতা, সব শিক্ষা, এখন দেশের তরুণ-সমাজের মধ্যে নিঃস্বার্থ বিলিয়ে দিতে তিনি সদা ব্যস্তআদ্যোপান্ত একজন আধুনিক মানুষ সত্ত্বেও ব্যক্তি জীবনে তিনি বিষয়ের প্রতি নির্মোহঅপছন্দ করেন ভোগ-বিলাসী জীবন, সব রকম আরাম-আয়েশ ও আত্মপ্রচারতাঁর মানবতাবাদী দর্শন, কর্মজীবনের আদর্শ, মার্জিত ও পরিশীলিত রুচি, বহির্বিশ্বে পদচারণা, গৌরব লাভ, দেশ প্রেম ইত্যাদি সবই নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এটাই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়

কোনো বিশেষ ব্যক্তি কী কর্মকাণ্ডের বলে সমাজে গৌরবান্বিত তা জানা আমাদের যেমন আগ্রহ তার চেয়ে আমরা আরও জানতে উৎসাহী তিনি কতোটা মানানসইতাঁর ঐতিহাসিক মর্যদায়ায় যদিও এর তেমন গুরুত্ব নেই তবুও সাধারণ মানুষের এ নিয়ে প্রবল কৌতুহলতারা ভাবেন এই মহত্ত্বের পেছনে নিশ্চয়ই কিছু অজ্ঞাত গুণাবলী, কিছু দূর্লভ বৈশিষ্ট্য, যা তাকে এতোটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ করেছেএ বিষয়ে স্যার সম্পর্কে যতোটা আলোকপাত করেছি তা থেকে এটাই প্রতীয়মান যে, তিনি তাকে রক্ষিত কোনো প্রযুক্তির বই নন, প্রাচীরপত্রে আঁকা কোনো পরিবেশবাদীও নন তিনি রক্তমাংসে গড়া একজন অতি সাধারণ মানুষ

এই চতুর্দশপদী কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁর ৭৮তম জন্ম বাষির্কীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর আমার এক দুঃসাহসিক প্রয়াস : জন্মদিনে কি দেবো? নাইতো রত্ম ধন,/ কামনাই শুধু তব দীর্ঘায়ু জীবন।/ চিরদিন থাকো সুখে আনন্দে উচ্ছাসে,/ অতৃপ্তি-অশান্তি যেন মনে নাই আসে।/ কতো ফুল ফুটিয়েছো অঙ্গনে-কাননে,/ কতো বৃক্ষ শোভে আজ নগর উদ্যানে।/ পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করবারে,/ বলেছ রোপিতে তরু তিনটি সবারে।/ প্রবন্ধ রাশি রাশি অনুবাদও কতো,/ সুখপাঠ্য সেইসব গ্রন্থবদ্ধ যতো।/ সান্নিধ্য পেয়েছে যতো তরুণে-নবীনে,/ দিপ্যমান আজ সবে তোমার কল্যাণে।/ দেশ হিতব্রতী তুমি দাদা যে সবার,/ ধন্য ধন্য ধন্য সব কৃতিত্ব তোমার

লেখক : অধ্যাপক ও প্রকৃতিবিদ

 
কুইজ
সায়েন্স ফিকশন
বিজ্ঞান প্রজন্ম
 বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা
স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা
উদ্ভাবন
পরিবেশ
 সায়েন্স টুন
 কম্পিউটারজগত
 দেশের খবর
 প্রযুক্তি অনলাইন
 মনোবিজ্ঞান
 বিজ্ঞান বিশ্বের খবর
 অন্যান্য রচনা
 পার্শ্ব রচনা
 বিশেষ রচনা
হোমপেজ
 প্রচ্ছদ রচনা