মনোবিজ্ঞান |
চেতনাবোধের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নির্মাণ
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়েগো শহরের নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী জেরাল্ড ইডেলম্যান একটি বৈজ্ঞানিক সেমিনারে মানুষের চেতনাবোধ বিষয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মানুষের চেতনাবোধ মস্তিষ্কের অত্যন্ত গতিশীল একটি ব্যাপার যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ইন্দ্রিয় তথ্য বিশ্লেষিত হয়। এই বিশ্লেষণ আমাদের চারপাশ সম্পর্কে, নিজের সম্পর্কে তথা যেকোনো বিষয় সম্পর্কে উপলব্ধির জন্য জরুরি। এই উপলব্ধিই জ্ঞানের ভিত্তি। আর জ্ঞান মানুষের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
অস্তিত্ব রক্ষার নিমিত্তে জীবের যে বিবর্তন, সেই বিবর্তনের পথ ধরেই মানুষ আজকের এই অবস্থানে। মানুষের শারীরিক গঠনের পাশাপাশি মস্তিষ্কের গঠনও তাকে অন্যান্য জীব থেকে আলাদা করেছে। এই মস্তিষ্কের মাঝেই বিবর্তনগতভাবে বেড়ে উঠেছে একটি প্রক্রিয়া যাকে বলা হয়, তথ্যবিশ্লেষণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার অন্যতম একটি ফলাফল হচ্ছে আমাদের চেতনা। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জন একলেসের সূত্র ধরে তিনি আরো বলেন যে, বিবর্তনের পাশাপাশি চেতনাগত প্রক্রিয়াকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার আলোকে দেখতে হবে। স্নায়ুগুলোর যে নিয়মতান্ত্রিক গতিশীলতা আর সংযোগ, তার কার্যকরণ সূত্র কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাই সর্বোচ্চ রূপে দিতে পারবে। অবশ্য তিনি এও বলেন, চেতনাগত প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায় কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে দার্শনিকদের কোয়ালিয়া নিয়েও। কোয়ালিয়া হচ্ছে এমন বস্তু, যার কারণে মানুষের মাঝে চেতনা বিরাজমান। জেরাল্ড ইডেলম্যান-এর মতে, যদিও বর্তমানে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা আর দর্শন থেকে আগত ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিকভাবে দৃঢ় ভিত্তি নিতে পারছে না, তবুও একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এই কারণে যে এগুলো থেকে চেতনাগত প্রক্রিয়ার উন্মোচন প্রচেষ্টা সঠিক দিক-নির্দেশনা পরোক্ষভাবে হলেও পাচ্ছে। ইডেলম্যান বলেন, মস্তিষ্কের সব অংশ নয়; বরং মোটামুটিভাবে থ্যালামোকর্টিকেল অঞ্চল সচেতন বোধের সাথে জড়িত। থ্যালামোকর্টিকেল অঞ্চলে ইন্দ্রিয় তথ্যগুলো পুরনো অভিজ্ঞতা সমন্বয়ে বিভিন্ন অংশে বিন্যস্ত ও পৃথকীকরণ হয় এবং তারপর তথ্যগুলোর সমষ্টিকরণ চলে। এই তথ্য সমষ্টিকরণের সমাপ্তি নির্ভর করে জীবের বা মানুষের সন্তুষ্টি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
চেতনাবোধকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা। থ্যালামোকর্টিকেল অঞ্চলের সবচেয়ে উপরের দিকে অবস্থিত প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। এই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে পরিকল্পনা আর চিন্তনের জায়গা। এখানেই থাকে সর্বোচ্চ সচেতনতা। তাছাড়া মনোযোগের সাথে জড়িত স্নায়ুগুলো এই অঞ্চলের সাথে সরাসরিভাবে যুক্ত। সংবেদী থ্যালামাস থেকে সচেতনভাবে বিশ্লেষিত হয়ে তথ্য বিভিন্ন ইন্দ্রিয় কর্টিকেল অঞ্চলে পৌঁছায়। যেমন দৃশ্য অঞ্চলে যায় দৃশ্যগুলো, শ্রবণ অঞ্চলে যায় শব্দগুলো, ঘ্রাণ অঞ্চলে যায় ঘ্রাণের তথ্য ইত্যাদি। এভাবে আমরা থ্যালামোকর্টিকেল নিচু মাঝারি স্তরের গঠন দ্বারা অঞ্চলের ইন্দ্রিয় তথ্য পেয়ে থাকি। এই তথ্য পরবর্তীকালে উঁচু স্তরে যাবে। এই উচ্চ স্তর হচ্ছে প্যারেইট্যাল কর্টেক্স, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, টেম্পোর্যাল কর্টেক্স আর অক্সিপিটাল কর্টেক্সের সুনির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের (সব অঞ্চল নয়) সমন্বিত রূপ। কি করে এই সমন্বিত রূপ তথ্যের সর্বোচ্চ বিশ্লেষণ করে। যেমন, অক্সিপিটাল কর্টেক্স তথ্যটিকে চিনে নিতে চেষ্টা করে। টেম্পোর্যাল কর্টেক্স তথ্যটির সাথে সম্পর্কযুক্ত পুরনো তথ্যগুলোকে বা স্মৃতিগুলোকে সচেতন করে তোলে। প্যারেইট্যাল কর্টেক্স প্রয়োজনীয় মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই তিন অঞ্চলের সাহায্যে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স চিন্তা করে বা পরিকল্পনা করে। এই চিন্তন বা পরিকল্পনা হচ্ছে তথ্য বিশ্লেষণ বা সচেতনার সর্বোচ্চ রূপ। এই সর্বোচ্চ রূপটিকে ব্যাখ্যার জন্য জেরাল্ট ইডেলম্যান সরল গণিতেরও সহযোগিতা নিয়েছেন। ইডেলম্যান সচেতন প্রক্রিয়ার স্তরীভূকরণের ধারণা পেয়েছেন বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার কচ ও ফ্রান্সিস ক্রিক-এর ‘ঘবঁৎড়নরড়ষড়মরপধষ অঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃড় ঈড়হংপরড়ঁংহবংং’ নিয়ে অধ্যয়ন করে। যেখানে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-এর পরিকল্পনা আর চিন্তনে অংশগ্রহণের কথা বলা আছে। আরো বলা আছে যে, সংবেদী থ্যালামাসে সচেতনভাবে বিশ্লেষণের পর অক্সিপিটাল লোবের ভিজুয়্যাল কর্টেক্সে দৃশ্যগুলো যায়। সেখানকার কিছু প্রসেসিং সচেতন কিছু অবচেতন। প্রাইমারি ভিজুয়্যাল কর্টেক্সের কাজ অবচেতন; কিন্তু সেকেন্ডারি ভিজুয়্যাল কর্টেক্সের কাজ সচেতন। ইডেলম্যান আরো বলেন, বিজ্ঞানী লাবার সচেতনতার জন্য যে গ্লোবাল ওয়ার্ক স্পেসের কথা বলেছেন, সেটিকে থ্যালামোকর্টিকেল সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর তার বন্ধু জি.টনোনির ‘ওহভড়ৎসধঃরড়হ ওহঃবমৎধঃরড়হ ঞযবড়ৎু’ মূলত তার তত্ত্বের ভিত্তিইÑ যেখানে তথ্য বিশ্লেষণই মূল কথা। তিনি বলেন, সেই ইন্দ্রিয় তথ্যই মস্তিষ্কে সচেতন স্তরে থাকে, যেটি আরো বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তাই কোনো নতুন ইন্দ্রিয় তথ্য সংবেদী থ্যালাম্যাসে পৌঁছালেই একই ধরনের তথ্য বা ঐ ইন্দ্রিয় তথ্য সম্পর্কিত তথ্য সচেতনতায় চলে আসে। কারণ নতুন তথ্যটি পুরনো তথ্যগুলোকে নতুনভাবে বিশ্লেষণের জন্য একটি ইনপুট। এভাবে ইডেলম্যান সচেতনতায় আসবে যে নিউরোন্যাল সিস্টেমগুলো কেন, কিভাবে, কি মাত্রায়, আসবে সেগুলো ব্যাখ্যা করেন। ইডেলম্যান সর্বশেষে, দুটো নিউরোন্যাল সিস্টেম ভাষা নিয়ন্ত্রণকারী নিউরন সিস্টেম এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী নিউরন সিস্টেমকে সচেতন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত করে তুলে ধরেন।
শেখা আর সচেতনতা
বিজ্ঞানী এরিক ক্যান্ডেল সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, ‘আমাদের যে আচরণগুলো আমরা সচেতন চিন্তাভাবনা ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে ফেলি, সেই আচরণগুলো এমন অবচেতন স্মৃতির মাধ্যমে সংঘটিত হয়, যার সচেতন মান আসার প্রয়োজন নেই। কোনো বিষয় শেখার মানে হচ্ছেÑ মস্তিষ্কে তা গেঁথে যাওয়া বা স্মৃতি হয়ে যাওয়া। এই স্মৃতির গঠন সচেতনভাবে পেতে হলে টেমপোর্যাল কর্টেক্সের হিপোক্যাম্পাসের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একই বিষয় বারবার করলে বা ঘটলে সেটির জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া আমরা অবচেনতভাবেই তথা হিপোক্যাম্পাসের সহযোগিতা ছাড়াই করা আরম্ভ করি। তিনি আরো বলেন, ‘হিপোক্যাম্পাস সচেতনভাবে নতুন স্মৃতি তৈরির পাশাপাশি প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে পরিকল্পনা বা চিন্তনের জন্য প্রয়োজনীয় স্বল্পস্থায়ী কার্যকরী স্মৃতি সরবরাহ করতে সহায়তা করে থাকে।’ তিনি এই বলে শেষ করেন যে, ‘আমাদের সচেতন যাবতীয় প্রক্রিয়া অবচেতন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। অবচেতন প্রক্রিয়াগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয় বলেই সচেতন প্রক্রিয়া অস্তিত্বশীল।’
গ্রন্থনা : নাসিম সাহনিক