প্লাইউড তৈরিতে নতুন কাঁচামাল এআরএম রকিবুল হাসান |
যেকোনো বাড়িকে স্বপ্নের মতো করে সাজাতে বর্তমানে প্লাইউডের ব্যবহার যেন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু যে হারে প্লাইউডের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুপাতে প্লাইউড তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল যোগান দেয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি প্লাইউড তৈরিতে নতুন কাঁচামালের যোগান হিসেবে অতি সহজলভ্য ‘পিটুলি’ গাছের কাঠ ব্যবহারে পরীক্ষামূলকভাবে সফলতা পাওয়া গেছে। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্লাইউড তৈরির জন্য নতুন এ কাঁচামালের সংযোজন (ব্যবহার) উদ্ভাবন করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোঃ হাসান শাহরিয়া।
প্লাইউড সাধারণত ব্যবহার করা হয় ঘরের ছাদ বা চালার নিচে, মেঝেতে, দেয়ালে। যাতে করে বাড়িকে গরমকালে বাইরের অধিক তাপমাত্রার এবং শীতকালে বাইরের অত্যধিক ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে যেখানে সাধারণত ক্ষতিকারক কোনো রাসায়নিক দ্রব্যাদি ঘরের মেঝেতে বা দেয়ালে পড়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে এসব ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্লাইউডের ব্যবহার অধিক নিরাপদ। এর পাশাপাশি অফিস-আদালত, দোকান, স্টেশনারি, ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ঘরের পার্টিশন (পৃথকীকরণ বা কক্ষ বিন্যাস) দেয়ার কাজে এ প্লাইউড ব্যবহার করা হয়। জানালা, দরজা, রান্না ঘর ও ড্রয়িং রুমের আসবাবপত্র রাখার জন্য বিভিন্ন তাক তৈরি, টেলিভিশন, ক্যাসেট, রেডিও রাখতে কাঠামো তৈরি, টেবিলের ওপরের অংশ এবং বিভিন্ন বক্স তৈরিতে প্লাইউডের ব্যবহার নিরাপদ।
অথচ আমাদের দেশে প্লাইউড তৈরিতে কাঠের যোগান আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। সেজন্য প্লাইউড তৈরির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে প্লাইউড সরবরাহ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য বেড়ে যাচ্ছে দাম। এসব নানা দিক চিন্তা করে প্লাইউড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে অত্যন্ত সহজলভ্য এ পিটুলি গাছের কাঠ ব্যবহারের নব পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে বলে উদ্ভাবক মোঃ হাসান শাহরিয়া জানান। তিনি আরো জানানÑ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় এ পিটুলি গাছ জন্মে থাকে এবং বীজ হতে অঙ্কুরোদগমন করার পর অতিদ্রুত পিটুলি গাছের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। এর আগে এ গাছ সাধারণত জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া ম্যাচের বক্স ও কাঠি, ছবি-বাঁধানো ফ্রেমসহ কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে কারণ পিটুলি গাছের দাম তুলনামূলকভাবে কম। আর বর্তমানে এ সস্তা দামের পিটুলি গাছ দিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তরুণ এ উদ্ভাবনক মনে করেন। ঠিক তেমনি পিটুলি গাছ যেকোনো স্থানে জন্মানোর ক্ষমতা থাকায় প্লাইউড তৈরিতে কাঠের যোগান দিয়ে তা আমাদের বনজ সম্পদের ওপর থেকে ব্যাপক হারে চাপ কমাতে সক্ষম হবে। এসব নানা বিষয় চিন্তা করেই প্লাইউড তৈরিতে পিটুলি গাছের মতো সহজলভ্য গাছের নতুন সংযোজন বা যোগান নিয়ে গবেষণা করা হয় বলেও উদ্ভাবক জানান।
ইতোপূর্বে প্লাইউড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে সাধারণ শিমুল, কদম, ছাতিয়ানাসহ অন্যান্য গাছের কাঠ ব্যবহার করা হতো। যা দিয়ে মানসম্মত প্লাইউড তৈরি করা গেলেও প্রয়োজনীয় কাঠের যোগানের অভাবে প্লাইউডের দাম দিনদিন বেড়েই চলছিল। কিন্তু বর্তমানে পিটুলি গাছের কাঠ দিয়ে প্লাইউড তৈরির ফলে এর দাম সকলের ক্রয়সীমার মধ্যে আসবে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। আর পিটুলি গাছের কাঠ দিয়ে তৈরিকৃত প্লাইউড বাজারের প্রচলিত যেকোনো প্লাইউডের চেয়ে কোনা অংশ কম মানসম্মত নয়। বরং এ প্লাইউড যথেষ্ট মানসম্মত, অধিক টেকসই এবং সৌন্দর্যময় বলে উদ্ভাবক জানান। এছাড়া নতুন উদ্ভাবিত এ প্লাইউড যেকোনো কাজে ব্যবহার উপযোগী হবে বলেও তিনি জানান।
তরুণ এ উদ্ভাবক বলেনÑ ‘একজন ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ছাত্র হওয়ায় বিভিন্ন ইন্ডান্ট্রিজ বা বাণিজ্যিক কারখানায় গিয়ে দেখতে পেলাম মাত্র গুটি কয়েক গাছ দিয়ে প্লাইউড তৈরি করা হয়। আর এসব গাছ ক্রমান্বয়ে এ দেশ থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যদি প্লাইউড তৈরিতে নতুন কোনো গাছের যোগান দেয়া সম্ভব হয়, তবেই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে প্লাইউডকে সহজলভ্য করা যাবে। পাশাপাশি বনজ সম্পদ উজাড়ের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাবো। আমার গবেষণার সুপারভাইজার ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আসাদুজ্জামানের পরামর্শক্রমে এ কাজে সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশায় ‘বিআরবি’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘এমআরএস’ ইন্ডাস্ট্রিজে যোগাযোগ শুরু করি। এ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শামসুর রহমানের আন্তরিক সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় প্লাইউড তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে পিটুলি গাছের কাঠ ব্যবহারে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফল হয়েছি। এ কাজে আরো সহযোগিতা করেন ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফেসর ড. ওবায়দুল্লাহ হান্নান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ ইফতেখার শামস।’
পিটুলি গাছ হতে (৮ ফুট ী ৪ ফুট আয়তন এবং ১৮ মিমি ঘনত্ববিশিষ্ট যেখানে এ প্লাইউডের উপরে এবং নিচে খুব পাতলা গর্জন গাছের ভিনিয়ার ব্যবহার করা হয়) প্লাইউড তৈরি করার পর তা বিভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল প্লাইউডের প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন, কি পরিমাণ চাপ সহ্য করতে পারে ইত্যাদিÑ বিষয়গুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়। এমনকি পিটুলি গাছের তৈরি প্লাইউডের চারদিকের আবহাওয়াগত পরিবর্তন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। উদ্ভাবক মোঃ হাসান শাহরিয়া বলেনÑ উপরের সবগুলো পরীক্ষা শেষে দেখা গেছে বাজারে প্রচলিত আন্তর্জাতিক মানসম্মত প্লাইউডের মতোই পিটুলি গাছের প্লাইউড যথেষ্ট টেকসই এবং মানসম্মত। প্লাইউড তৈরিতে পিটুলি গাছের মতো সস্তা গাছের ব্যবহার আমাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করার পাশাপাশি প্লাইউড তৈরির জন্য বর্তমানে যেভাবে কাঁচামালের যোগান দিতে কাঠের অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে তা থেকে কিছুটা হলেও আমরা রক্ষা পাবো এবং আমাদের দেশের মূল্যবান কাঠ তথা বনজ সম্পদের ওপর থেকে চাপ কমানো সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। প্লাইউড তৈরিতে পিটুলি গাছের ব্যবহারের উদ্ভাবক যশোর জেলার, চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা গ্রামের মোঃ ছাদেক আলী বিশ্বাসের পুত্র। পিটুলি গাছ থেকে প্লাইউড তৈরিসহ যেকোনো বিষয়ে জানার জন্য উদ্ভাবকের সাথে সরাসরি মোবাইলে : ০১৭১৭-৬৬৬৪৬০, ০১৭১১-০১০৯১৫ অথবা যধংধহংযধযৎরধশঁ@ুধযড়ড়.পড়স এই ঠিকানায় যোগাযোগ করা যেতে পারে।