একজন বৈজ্ঞানিক-কবি

আমিরুল আলম খান

অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি উদ্ভিদজগতের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে চলেছেন, সেতুবন্ধন রচনা করে চলেছেনতাঁর উপস্থাপনা এতোই কাব্যিক যে তাঁকে কবি বলাই যায়অন্তত কবিতা এবং বিজ্ঞানের যে সংশ্লেষ আমরা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে পাই তা অনবদ্য দ্বিজেন শর্মার রচনাশৈলীর অনবদ্য বিবরণ উপস্থাপন করছেন

প্রফেসর দ্বিজেন শর্মার কোনো লেখা প্রথম পড়েছি, কবে পড়েছি তা স্মৃতি হাতড়ে উদ্ধার করা কঠিনতবে প্রথম পাঠেই যে তাঁর রচনার প্রেমে পড়েছি তা হলফ করে বলতে পারিতাঁর রচনা পাঠের পর আমার মনোলোকে তাঁর একটি স্থায়ী প্রভাব পড়ে যায়সে প্রভাব এমনই যে, একই বিষয়ে লিখতে বসলে তাঁর লেখা ভেঙে নতুন কিছু লেখা যেন আমার সাধ্যাতীত মনে হয়বিষয়ের ওপর তাঁর দখল, উপস্থাপনার ভাষা ও কৌশল, রচনাশৈলী মোহাবিষ্ট করে রাখে আমাকে

তিনি কবি না বিজ্ঞানী সে প্রশ্ন তোলাই যায়তবে সিদ্ধান্তে আসতে গেলে বোধহয় বলা যাবে, তিনি একাধারে বিজ্ঞানী ও কবিবিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বা কর্মজীবনকে মাপকাঠি ধরলে তিনি নিশ্চয়ই একজন বিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানীঅধ্যাপনার পাশাপাশি প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি উদ্ভিদজগতের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে চলেছেন, সেতুবন্ধন রচনা করে চলেছেনতাঁর উপস্থাপনা এতোই কাব্যিক যে তাঁকে কবি বলাই যায়অন্তত কবিতা এবং বিজ্ঞানের যে সংশ্লেষ আমরা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে পাই তা অনবদ্য

প্রকৃতপক্ষে বাংলার নিসর্গকে, তার উদ্ভিদ সম্পদকে আমরা এতোদিন চিনেছি কবি-সাহিত্যিক-চিত্রশিল্পীদের কবিতায়, গানে, গল্পে-উপন্যাসে বা চিত্রাবলিতে কিংবা বিজ্ঞানের কঠিন পরিভাষায়তাই শিল্পক্ষেত্রে বৃক্ষরাজি যতোই মনোহর প্রতিভাত হোক না কেন, উদ্ভিদশাস্ত্রীয় বর্ণনা সাধারণ পাঠকচিত্তে তেমন আলোড়ন তোলে না; কিন্তু সে অপরিচয়ের প্রাচীর ভেঙে দ্বিজেন শর্মা আমাদের সম্মুখে উদ্ভিদজগৎকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে তখন প্রকৃতির জটিল বিষয়াবলি পাঠ যেন নিতান্তই সহজ একটি বিষয়ে পরিণত হয়, সুখপাঠ্য সাহিত্যে উন্নীত হয়তাঁর ভাবনায়, অবশ্যই উদ্ভিদজগৎ প্রধান বিষয় কিন্তু তাঁর সাথে বাস্তুসংস্থান বিদ্যায় বাংলা ভাষায় তাঁর চেয়ে বেশি আর কে লিখেছেন? সেসব রচনায় তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে যখন আলোচনা করেন তখন তাতে প্রধান হয়ে উঠে একদিকে বিজ্ঞান এবং অন্যদিকে নন্দনশাস্ত্রঅর্থাৎ বিজ্ঞানের আলোচনা করতে যেয়ে তিনি সব উপস্থাপনায় যে নান্দনিক জগৎ নির্মাণ করেন তাতে পাঠক এক ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যানসে জগৎ একদিকে যেমন আমাদের এই পরিচিত পৃথিবী, আবার মনে হয় সে পৃথিবী একান্তই কল্পিত, যেন সেই জগৎ আমাদের নির্মাণ করতে হবে তিনি তাঁর রূপরেখা দেনঅথচ কি আশ্চর্য, বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যের রঙ-রস-কল্পনা মেশাতে যেয়ে তিনি কখনও বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে আপস করেন না

বাংলাদেশের উদ্ভিদজগৎকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে দ্বিজেন শর্মার চেয়ে বেশি কাজ বোধহয় আর কেউ আজ পর্যন্ত করেননিশ্যামলী নিসর্গ এক অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীর মনের দর্পণ, যার মধ্যে প্রথমত, আমরা ঢাকা শহরের বৃক্ষ সম্পদের খোঁজ পাই এবং সারা বাংলাদেশকেও আবিষ্কার করিগোটা বাংলা সাহিত্যে সমমানের গ্রন্থ আর নেইযখন তাঁর নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনাবইটি পাঠ করি তখন মনে হয় একজন তরুবিদ কি অপরিসীম দরদে নিজ বাসভূমিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে গড়ে তোলার জন্য নিরন্তর সচেষ্টএখানে বিজ্ঞান এবং নান্দনিকতা যুগলবন্দিআশা এবং হতাশা সহযাত্রীতিনি রাষ্ট্রের অপবৈজ্ঞানিক অপকীর্তির বিরুদ্ধে সদা সোচ্চারএটি সম্ভব হয় তখনই, যখন একজন মানুষের মানবপ্রেম, দেশপ্রেম সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যান

বিগত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন প্রচুরমৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্ভিদশাস্ত্র, বিজ্ঞান বিষয় হলেও তাঁর লেখার পরিধি সমাজ, শিক্ষা ও রাজনীতি পর্যন্ত পরিব্যাপ্তনিজের মৌলিক গ্রন্থ ১৬টি, অনুবাদ গ্রন্থ প্রায় ৩০টিঅনুবাদকের চাকরি নিয়ে তিনি প্রায় দুই দশক কাজ করেছেন প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায়, মস্কোর প্রগতি প্রকাশনীতেঅনূদিত বেশির ভাগ কাজ করেন তখনই দ্বিজেন শর্মার রচনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি শ্যামলী নিসর্গ’, ‘নিসর্গ নির্মাণ নান্দনিক ভাবনা’, ‘কুরচি তোমার লাগি বা মম দুঃখের সাধন পাঠ করলে প্রকৃতি, পরিবেশ সুরক্ষা, সৌন্দর্যায়ন, বাস্তুসংস্থান সঙ্কট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে চিন্তার সম্যক পরিচয় লাভ করা যায়এক্ষেত্রে তাঁর গহন কোন বনের ধারে’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘সতীর্থবলয়ের ডারউইন’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগলযাত্রীর ভ্রমণকথাইত্যাদি অসাধারণ গ্রন্থএমনই সুখপাঠ্য যে একবার পাঠ শুরু করলে শেষ না করে থামা যায়নাসোভিয়েত শিক্ষাবিদ লুনাচারক্সির শিক্ষা এবং ড্যালটন হুকারের ভ্রমণকাহিনীর অনুবাদ হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকারতাঁর অনুবাদ দক্ষতার পরিচয় বহন করে তাঁর গ্রন্থ পাঠ করার অর্থই আনন্দকে পাঠ করা, আনন্দকে নতুনভাবে অনুভব করাএখানেই দ্বিজেন শর্মার বৈশিষ্ট্যতিনি যখন বৃক্ষকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তখন নান্দনিকতার নতুন মাত্রা অর্জন করে, আমাদের হৃদয়ে শিল্প ক্ষুধাকে তীব্রতর করেতাঁর বর্ণনার কাব্যময়তা বাংলা গদ্য সাহিত্যের শক্তির নতুন মাত্রা নির্দেশ করে

দ্বিজেন শর্মা কখনো বৃক্ষকে আলাদা করে দেখেন নাতাঁর রচনায় প্রকৃতি ও বৃক্ষ প্রায় সমার্থক এবং বাস্তুসংস্থান বিদ্যার নানা জটিল বিষয়ের সহজ সাবলীল ব্যাখ্যা পাওয়া যায়প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের পাশাপাশি নগরায়নে কিভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণœ রাখা সম্ভব বা অক্ষুণœ রাখা উচিত সে বিষয়ে তাঁর নিরন্তর ভাবনা আমাদের একটি নান্দনিক নগরায়নের স্বপ্ন দেখায়সে ক্ষেত্রে তিনি কখনো আমাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বিস্মৃত হন না

দ্বিজেন শর্মা যে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী সেটা জানি তাঁর উদ্ভিদ বিষয়ক রচনা পড়েকিন্তু যখন তাঁর অনুবাদ পড়ি, ব্যক্তিগতভাবে যারা তাঁর সাথে পরিচিত, তারা জানেন সব মানুষকে আপন করে নেয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে এই কবি-বিজ্ঞানীরযতোবার তাঁর সাথে কথা বলেছি ততোবারই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর আন্তরকিতায়জীবনের সাতাত্তরটি বসন্ত তিনি অতিক্রম করেছেনআমরা তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুখী জীবন কামনা করি

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোর

 
কুইজ
সায়েন্স ফিকশন
বিজ্ঞান প্রজন্ম
 বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা
স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা
উদ্ভাবন
পরিবেশ
 সায়েন্স টুন
 কম্পিউটারজগত
 দেশের খবর
 প্রযুক্তি অনলাইন
 মনোবিজ্ঞান
 বিজ্ঞান বিশ্বের খবর
 অন্যান্য রচনা
 পার্শ্ব রচনা
 বিশেষ রচনা
হোমপেজ
 প্রচ্ছদ রচনা