যাত্রাপথের আনন্দগান

দেবী শর্মা

দ্বিজেন শর্মার জীবনে তিনি জড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই ষাট সালের নভেম্বরেতারপর থেকে পরম সুহৃদ হিসেবে একত্রে পার করেছেন উজ্জ্বল যৌবন, জীবনের সব স্বপ্ন আর সাধদেবী শর্মাÑ দ্বিজেন শর্মার সহধর্মিণী এবার সেই আলোচনায় মগ্ন হলেন...

পরিচিত কেউ বরিশালে দ্বিজেন শর্মার ঠিকানা আনতে কাঁঠালতলী ওদের বাড়ি গেলে আমার শাশুড়ি তামাশা করে বলতেনÑ ‘ঠিকানা লাগবে নাযে-বাড়ির সামনে দেখবে বাগান, ঘরে অনেক বইপত্র আর উঠানে কুকুর, জানবে খোকা ওখানেই আছে, কিংবা ওরাই নিয়ে যাবে তার কাছেখোকা, দ্বিজেন শর্মার ডাকনামতিনি সঠিক তথ্যই দিয়েছিলেনবাগান, বই, কুকুরÑ এ নিয়েই কাটিয়েছেন প্রায় সারাজীবনসিদ্দিক ভাই (বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা সিদ্দিকুর রহমান) ব্রজমোহন কলেজে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের রিহার্সেলের জন্য আমাদের যখন নিয়ে যান কলেজের হোস্টেল সুপারের বাসায় তখনও জানতাম না ওটি দ্বিজেন শর্মার আস্তানাএকটি টিনের ঘর, সামনে বাগান, খোলা জানালার পাশে বইয়ের শেলফ এবং দরজায় একটি কুকুরতখন কে জানতো আমিও জড়িয়ে পড়বো এসবের সাথে এবং অচিরেইআমাদের বিয়ে হয়েছিল ষাট সালের নভেম্বরেকিছুদিন ছিলাম হোস্টেলের বাড়িতে লন ঘিরে নানা ফুলের গাছ, তারপর পুকুর, ওপারে ধানক্ষেত, বহুদূরে মাজারের ওপর অনেকগুলো শিরীষগাছঅপূর্ব নিসর্গ শোভামাঝে মধ্যে ডা. এম. আহমেদ আসতেন সাদা দাড়ি, ঋষিকল্প মুখশ্রী, জন্মনিসর্গীবাগানে বসে গল্প করতেন দুজনে, আলোচনা গড়াতো অর্কিড ক্যাকটাস থেকে আমাজন লিলি অবধি, কখন গ্রে-প্যারোট, মাকাও, ময়ূরবাংলাদেশে আমাজন লিলি চাষের প্রবর্তক তিনিআমার পিত্রালয়ের পুকুরেও একটি লাগান, মিটারখানেক চওড়া পাতা ছড়িয়ে সবাইকে অবাক করেছিল

বাবা আমাকে ছাড়া থাকতে পারতেন নাতাই দ্বিজেন শর্মাকে অনেকটা সময় কাটাতে হতো আমাদের বগুড়া বোর্ডের বাড়িওখানেও তাই বাগান হলো, বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে এলো একটি কুকুরÑ খানদানি জার্মান ডেশনবারান্দায় এক কোণায় খাঁচা বানিয়ে রাখলেন নানা রঙের লাভ বার্ড আর মুনিয়াসেইসব দিন ভোলার নয়বরিশালের বন্ধুরা সকলেই আসতেন, আড্ডা জমতো লনে আর সেই সাথে আমার মায়ের অপূর্ব স্বাদের লুচি ও আলুর দমএখানে বসেই দ্বিজেন শর্মা লেখেন ডারউইন বিষয়ক গ্রন্থাবলির প্রথম খণ্ডের খসড়া (পিতামহ, সুহৃদ, সহযাত্রী), পরে যেটি প্রকাশিত হয় সতীর্থবলয়ে ডারউইন নামে

আমাদের বাড়িতে বাগান তৈরি নিয়ে অনেক মজার গল্প আছেসেকালে বরিশালে কোনো নার্সারি ছিল না, তবে অনেকের ব্যক্তিগত বাগানের সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়।             ডা. আহমেদের কথা আগেই বলেছিঅর্কিড, ক্যাকটাস ছাড়াও তাঁর সারা বাড়িতে ছিল অজস্র গাছগাছালিচন্দ্রকান্ত ডাক্তারের বাড়িÑ সে তো মিনি বোটানিক গার্ডেনগোটা বেল্স পার্ক জুড়ে ছিল আরএসএন কোম্পানির অনেকগুলো বাগানঘেরা কোয়ার্টারসর্বত্র দ্বিজেন শর্মার অবাধ যাতায়াত, মালিদের সাথে দোস্তিসুতরাং আমাদের বাড়ি এলো হাজার রকমের গাছাপালা; কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্যত্রগাছগুলো থিতু হওয়ার সুযোগ পেত নাÑ আজ এখানে তো কাল ওখানেতুঘলকি কাণ্ডমাঝে মধ্যে কোর্টে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে ডেকে বলতেনÑ ‘ওরে এই গাছটি এখানে তো ভালোই দেখাচ্ছে; কিন্তু বাড়ি ফিরে ওখানে দেখবো কি?’ আসলে দ্বিজেন শর্মা বড় হয়েছেন পাহাড়ী এলাকায়, ওখানকার নিসর্গ তার অস্থিমজ্জায়, তেমন একটি শোভা সৃষ্টি করতে চাইতেন আমাদের সমতল বাংলায়, সেটা হয়ে উঠতো না, যেজন্য এই উচাটন

আমরা ১৯৬২ সালে ঢাকা চলে আসিনটরডেম কলেজে চাকরি ওর জীবনের সর্বোত্তম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলএই মিশনারি বিদ্যায়তনে বিদ্যমান উন্নত বিশ্বের পরিবেশ ছিল ওর জন্য এক নতুন জগৎফাদার বেনাস তাকে শেখান ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনিং, ফাদার টিম যোগান শ্যামলী নিসর্গ লেখার প্রয়োজনীয় সব আকরগ্রন্থ, নিজের ল্যাবরেটরি ছেড়ে দেন ক্যারোফাইটানামের শৈবাল গবেষণার জন্য, ফাদার গ্রেহাম ও হুইলার দেন জীববিদ্যা বিভাগ পুনর্গঠনের পুরো দায়িত্বএখানে বসেই তিনি লেখেন তার শ্রেষ্ঠ রচনা ঢাকার পথতরুর ইতিবৃত্ত ও জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থ জীবনের শেষ নেইকলেজ তাকে এতোটাই আবিষ্ট করেছিল যে রাশিয়ায় থাকার সময় মনোজগতে অনেকটা সময় ওখানেই কাটাতেন এবং ওই ক্যাম্পাসে ফেরার দিন গুণতেন

১৯৭৪ সালে রাশিয়া যাওয়ার সুযোগ ওর সামনে ইউরোপের দুয়ার খুলে দিয়েছিলব্যাপারটা ঘটেছিল অনেক দেরিতে পড়াশোনা আর সম্ভব ছিল না, তবে তার অনেক স্বপ্নসাধই পূর্ণ হয়েছিলÑ গিয়েছিলেন ডারউইনের জন্মস্থান ও কর্মস্থলে, দেখেছিলেন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের নামী বাগান ও পার্কগুলো, বইপত্র কিনতে পেরেছিলেন ইচ্ছামতোকতো সকাল-সন্ধ্যা আমরা একত্রে কাটিয়েছি কিউ উদ্যানে, যেন ফিরতেই চাইতেন নাভবিষ্যতে লেখালেখির উপকরণের ভাণ্ডারটি এভাবেই ভরাট করেছিলেন

মস্কোয় সবগুলো বাড়িই বহুতল, চারদিকে অঢেল খোলা জায়গা, অজস্র গাছগাছালিআমরা থাকতাম তেমন এক বাড়ির নতলায়বাড়িটি ঘিরে দ্বিজেন শর্মা গড়ে তোলেন একটি বাগান প্রায় একক চেষ্টায় ও নিজের গতর খাটিয়েসেদেশে কোনো গার্ডেন সেন্টার ছিল না, তাই গাছপালা আনেন পাশের বন থেকে, পরিত্যক্ত গ্রাম থেকেলাগান বার্চ, ম্যাপল, ক্রেব-আপেল, রোয়ান ইত্যাদি বড় বড় গাছ এবং লাইলাক, জংলি চেরি, ইউরোপীয় জুঁই জাতীয় ঝোপঝাড় আর প্রত্যেক গ্রীষ্মে নানা রঙের মৌসুমী ফুলরাশিয়ায় বইপত্র সস্তা, তাই কয়েক বছরের মধ্যেই ফ্ল্যাটের একটা অংশ গেল লাইব্রেরির দখলে আর এলো সেই অনিবার্য কুকুর, একটি স্পেনিয়েল, পপিঢাকার মতোই জমজমাট আনন্দঘন একটি সংসার গড়ে ওঠে সেখানেওদ্বিজেন শর্মা প্রায় বিশ বছর অনুবাদকের কাজ করেছেন, তাতে আমার মতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি, কোনো সৃজনশীল মানুষের পক্ষে দীর্ঘ বিদেশবাস ও অনুবাদের মতো একঘেয়ে কাজ অত্যন্ত অনিষ্টকরদ্বিজেন শর্মা এখন দুঃখ করে বলেন যে তার অনূদিত বইগুলোর মধ্যে ৪-৫টি বিজ্ঞানের এবং ২-৩টি অন্য ধরনের বই ছাড়া বাকি সবই বর্জে পর্যবসিততবে একটিই তার বড় অর্জন মনে করেন আর সেটি ও-দেশে দীর্ঘদিন থাকার অভিজ্ঞতার আলেখ্য সমাজতন্ত্রে বসবাস’, একটি পরীক্ষামূলক সভ্যতার ইতিবৃত্ত

১৯৯৫ সালে আমরা স্থায়ীভাবে দেশে ফিরিতারপরও দ্বিজেন শর্মা মস্কো যাতায়াত করেছেন ২০০৬ সাল পর্যন্তকুকুরটি আর নেইবইপত্রের বেশির ভাগই দিয়ে দিয়েছেন মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকেবাগানের সুন্দর গাছপালা সবই চুরি হয়ে গেছেআছে বৃক্ষ ও ঝোপঝাড়বার্চ গাছের দশতলার জানালা অবধি পৌঁছে গেছে, ম্যাপলরা রীতিমতো মহীরুহ

পুরনো বন্ধুবান্ধব কয়েকজন আজও আছেন আশপাশের ফ্ল্যাটে, সবাই বৃদ্ধ ও অসুস্থসেখানে দ্বিজেন শর্মার অলস সময় কাটে তাদের সাথে আলাপে, দুপুরে কাছের এক খোলাবাজারে ঘুরেফিরে এবং ঘরে বসে হারানো দিনের স্মৃতিচারণে যখন এ সংসার ছিল নিজেদের ও বন্ধুবান্ধবদের সন্তানসন্তিতে একদা কলরবমুখরতাই ও-দেশে যাওয়া বাতিল করে এখন থিতু হয়েছেন দেশেভাড়া করা ফ্ল্যাটবাড়িতে বাগান নেই, কুকুর পোষাও অসম্ভব, তবে আছে বইপত্র এবং প্রকৃতিপ্রেমী মুরিদবর্গলেখালেখি, আলাপ-আলোচনা, দূরের ও কাছের বনবনানী ভ্রমণ বনজঙ্গল থেকে আনেন দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির গাছগাছালি, লাগান বাংলা একাডেমী, শিশু-একাডেমী চত্বরে ও রমনা পার্কে শুনেছি আমার শ্বশুরমশায়েরও এমন নেশা ছিল, গাছপালা লাগাতেন পথেঘাটে, অন্যের বাড়িআপাতত এসব নিয়ে ভালোই আছেন দ্বিজেন শর্মা

লেখক : গল্পকার, অধ্যাপক

 
কুইজ
সায়েন্স ফিকশন
বিজ্ঞান প্রজন্ম
 বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা
স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা
উদ্ভাবন
পরিবেশ
 সায়েন্স টুন
 কম্পিউটারজগত
 দেশের খবর
 প্রযুক্তি অনলাইন
 মনোবিজ্ঞান
 বিজ্ঞান বিশ্বের খবর
 অন্যান্য রচনা
 পার্শ্ব রচনা
 বিশেষ রচনা
হোমপেজ
 প্রচ্ছদ রচনা