দ্বিজেন শর্মার শিশু ভাবনা মোকারম হোসেন |
দ্বিজেন শর্মার প্রায় সব ভাবনার মধ্যেই শিশুরা প্রবলভাবে উপস্থিত রয়েছে। শিশুর মতোই সরল মনে তিনি জগৎ ও জীবনের সব সৌন্দর্যকে দেখতে চান। তাঁর সকল সৃষ্টি ও গবেষণা এবং প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এই ভাবনাই বারবার ফুটে ওঠে। শিশুর মনে স্বপ্ন জাগানিয়া অন্য এক দ্বিজেন শর্মার প্রতিকৃতি তুলে ধরছেন মোকারম হোসেন...
অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে আমার পরিচয় পর্বটা খুবই স্মরণীয়। একদিন অভ্যাসবশত ঘুরে ঘুরে রমনা পার্কের গাছপালা দেখছি, ছবি তুলছি। হঠাৎ দেখি একজন দলপতির পেছনে কয়েকজন তরুণ-তরুণী ছুটছে। পুরো দলটি ছুটে ছুটে এ-গাছ থেকে ও-গাছে যাচ্ছে। দলপতি প্রতিটি গাছের নিচে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কোমল কণ্ঠে গাছটির বর্ণনা দিচ্ছেন। তাঁর শুভ্র কেশের সঙ্গে নিষ্পাপ চেহারায় অদ্ভুত এক দ্যুতি ছড়ানো ছিল। আমার মনে হলো কোনো এক দেবদূত গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করছেন। মন্ত্র-মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। মিশে গেলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই তরুণ শিক্ষার্থী দলটির সঙ্গে। সবার সঙ্গে গোটা পার্কটিই ঘুরে বেড়ালাম। কাগজ-কলম বের করে প্রয়োজনীয় নোট নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই দলপতি অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতির পাঠশালার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এতক্ষণে তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ তৈরি হলো। শুধু নাম বললে আমাকে চেনার কোনো কারণ নেই তাই কর্মস্থলের নাম ও আমার বৃক্ষপ্রীতির কথাও জানালাম। মৃদু হেসে বললেন, ‘খুবই ভালো কথা, আমার ফোন নম্বরটা রাখো, যোগাযোগ করবে।’ এই সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের সূত্র ধরেই শুরু। তাঁর প্রকৃতি বিজ্ঞানের পাঠশালায় আজীবন ছাত্র হিসেবে যোগ দিলাম। এমন শিক্ষক, অবিভাবক ও বন্ধুর দুর্লভ সান্নিধ্য আর কোথাও পাইনি, পাবো বলেও মনে হয় না। তার অফুরন্ত ভাণ্ডার উজাড় করেই শেখাতে চান আমাদের। এমন পণ্ডিত ও উদার মানুষটির শিশুতোষ ভাবনা লিখতে বসে খানিকটা সমস্যায়ই পড়া গেল। তার কর্মপরিধি এতোটাই বিস্তৃত যে কোন্টা রেখে কোন্টা বলি।
দ্বিজেন শর্মার প্রায় সব ভাবনার মধ্যেই শিশুরা আছে প্রবলভাবে। শিশুদের মতো সরল মনেই দেখতে চান জগতের সব সৌন্দর্য। তাঁর সব সৃষ্টি, গবেষণা ও প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে তা বারবারই ফুটে ওঠে। তরুণ বয়সেই অধ্যাপনা ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূর রাশিয়াতে। অনুবাদক হিসেবে যোগ দেন মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে। তাঁর অনুবাদের সুবাদে রাশিয়ার সমৃদ্ধ শিশুসাহিত্য বাংলা ভাষাভাষীদের নাগালে চলে আসে। শিশুরা সেসব বই পড়ে অন্যরকম স্বাদ পেতে শুরু করে। কারণ সেখানে স্বপ্ন, বাস্তবতা, ভাষার সাবলীলতা, জীবন্ত অলঙ্করণ সবকিছুই ছিল। না বললেই নয় যে, সত্তর দশক থেকে যারা শিশুসাহিত্যে নিয়মিত, তারা এ বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করবেন। রাশিয়ার এসব অনূদিত বই আমাদের শিশুসাহিত্যেও বিরাট ভূমিকা রাখে এবং শিশুসাহিত্যিকদের কল্পনার খোরাক যোগায় দীর্ঘদিন। প্রসঙ্গত ননী ভৌমিক ও ড. হায়াৎ মামুদও স্মরণীয়। তাদের অনুবাদও আমাদের শিশুসাহিত্যকে নানাভাবে অলঙ্কৃত করেছে।
দ্বিজেন শর্মা প্রবাস জীবনেও প্রিয় বিষয় উদ্ভিদবিজ্ঞান চর্চায় নিয়মিত ছিলেন। বাসার এক চিলতে আঙ্গিনায় রচনা করেন বাগান। আর অনুক্ষণ ভাবেন দেশের শ্যামলী নিসর্গের কথা; কিন্তু এসবের ফাঁকে আরেকটি ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। মস্কোয় বসবাসরত বাংলাভাষাভাষী শিশুদের পড়াশোনা হবে কী করে? সেখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো ছিল স্বল্প আয়ের বাঙালিদের নাগালের বাইরে। তাছাড়া বাঙালি হয়ে বাংলা জানবে না, এও তো হতে পারে না। তাদের জন্য একটি স্কুল চাই। সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে তৈরি করলেন স্কুল। এতে অবশ্য বাংলাদেশ দূতাবাসেরও সহযোগিতা ছিল। দূতাবাসের কিছু জায়গা বরাদ্দ হলো স্কুলের জন্য। এই স্কুলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই ছিলেন অবৈতনিক। প্রবাসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িতরা স্বেচ্ছায় পাঠদান করতেন। কঠিন নিয়মকানুনের বালাই ছিল না। তিনি মনে করেন শিশুদের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করলে তাদের সঠিক বিকাশ হয় না। তবে অত্যন্ত কৌশলে শৃঙ্খলার বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে হবে। স্কুলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও শিশুদের সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ যোগানো হতো। এই স্কুল চললো অনেক দিন। তার এমন ভাবনাই শিশুদের প্রতি অনুরাগের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
অনুবাদকের চাকরির পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চায়ও তিনি নিয়মিত। তাঁর ভাবনাগুলো সবসময়ই পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তা অবশ্যই দরদ মেশানো ও সুখপাঠ্য। তিনিই মূলত এখানে সাহিত্যাশ্রয়ী বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পুরোধা। উদ্ভিদবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সাহিত্যের সুধা ঢেলে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনিই প্রথম উপস্থাপন করেন। কিন্তু সবকিছুর আড়ালে শিশুতোষ ভাবনা উদ্দীপ্ত করে বারবার। শিশুদের মনোজগৎ ছুঁয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে আলোর পথে। আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে প্রকাশিত হয় কিশোর বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘জীবনের শেষ নেই’। এ গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধই মাসিক ‘টাপুর টুপুর’-এ প্রকাশিত। ছোটদের পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের কাছেও ব্যাপক আদৃত। ১১টি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধকে প্রবন্ধ না বলে গল্প বলাই শ্রেয়। কারণ বইয়ের উপজীব্য বিজ্ঞানের আবিষ্কার, গবেষণা, ইতিহাস, সাফল্য, জীবনী সবকিছুই তিনি বলেছেন গল্পের ঢঙে। জটিল তত্ত্ব, তথ্যে ভরা বিষয়কে গল্পের ছলে বলে যাওয়ার জন্যও লেখককে গল্পকার হতে হয়। শিশুরা গল্প পছন্দ করে। গল্প করতে করতে লেখক কখন যে মূল কথাটা বলে ফেলেছেন তা টেরই পাওয়া যায় না। তাদের পছন্দের জগতে প্রবেশ করানোই যে লেখকের উদ্দেশ্য। আর তাতে সুবিধাও অনেক। ছোটরা একবার মজা পেলে বারবারই সে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাবে। ‘জীবনের শেষ নেই’ গ্রন্থে লেখক সেই কৌশলেরই আশ্রয় নিয়েছেন। আমি নিশ্চিত যেকোনো শিশুই এই বই পাঠে দ্বিধা বা বিরক্তি বোধ করেনি। এখানে লেখক বরেণ্য বিজ্ঞানীদের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে প্রকারান্তরে তাদের মনে স্বপ্নই জাগিয়েছেন।
মস্কো বসেই তিনি দেশের সাহিত্যাঙ্গনের খবরাখবর রাখতেন। লেখালেখিটাও ছিল নিয়মিত। দেশে ফিরে আবার গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন বিজ্ঞান চর্চায়। লেখালেখির সুবাদেই বাংলা একাডেমী ও শিশু একাডেমীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের শিশুতোষ পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’ ও ‘শিশু’সহ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘নাবারুণ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। অধিকাংশ লেখাতেই থাকে প্রকৃতি ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গ। তার শৈশব-কৈশোর, স্কুলজীবন, প্রকৃতির রহস্যময়তা, অভিজ্ঞতা-এ এসব প্রসঙ্গই আসে বারবার। শৈশব তাঁর কাছে এক সুবর্ণ অতীত। যতোটা প্রাণ-প্রাচুর্যের ভেতর তারা বড় হয়েছেন, এখন ছোটদের জন্য তার ছিটেফোঁটাও নেইÑ এ প্রসঙ্গ তিনি বারবারই নিয়ে আসেন। শৈশব তাঁকে অনুক্ষণ মাতিয়ে রাখে। প্রবাসে তা আরো প্রবল ও আবেগতাড়িত। ১৯৯৩ সালে মস্কো প্রবাসে লেখা ছোটদের একটি বইয়ের মুখবন্ধে সেই স্মৃতিকাতরতাই ফুটে ওঠে, ‘আমি এই সুদূর প্রবাসে আমার মেয়েকে কখনো কখনো নিজের ছেলেবেলার কথা শোনাই। গ্রামে বড় হয়েছি। প্রকৃতির প্রতিটি ঋতুর বর্ণ-গন্ধ-স্পন্দন আমার রক্তকণায়। এ কাহিনী তাই ফুরোতে চায় না। এ গল্প শেষ হয় না। ফাল্গুনে অশোকমঞ্জরি সুবাসিত সকালে ফুলের সাজি হাতে বাড়ি বাড়ি ঘোরা, প্রথম বৃষ্টির পর মাটির সোঁদা গন্ধ, বৈশাখের ছায়াঘন দিন, রাতভর হাওয়ার মাতলামি, ভোরে আমকুড়োনের ধুম, বর্ষার এগিয়ে আসা ঘোলা জলে অবিরাম সাঁতার, রথের মেলার সেই আশ্চর্য বাঁশির সুর, বাদল বাউলের অবিশ্রান্ত একতারা শুনে শুনে কাঁথার ওমে ঘুমিয়ে পড়া, শরতের কাকচক্ষু বিল থেকে শাপলা তোলা...।’ নিজে স্বপ্ন দেখেন, শিশুদের মনে স্বপ্ন জাগাতেও পছন্দ করেন। শিশুরা স্বপ্নের ভেতর বড় হতে থাকলে জাগতিক মোহ-মায়া তাদের আচ্ছন্ন করতে পারে না। তখন তারা শুধু কল্যাণ ও শান্তির কথাই ভাবে। তারা যদি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়, তখন তার প্রতি ভালোবাসা জন্মে, দায়িত্ববোধ বাড়ে। সমাজ গড়ার সদিচ্ছা তৈরি হয়। কারণ প্রকৃতির কল্যাণের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় কল্যাণ জড়িতÑ এই গূঢ় সত্যটি দ্বিজেন শর্মা তাঁর কথায় ও লেখায় ছোটদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন বারবার। তিনি মনে করেন শিশুরাই একটি আদর্শ ও কল্যাণকর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ বাতিঘর।
দ্বিজেন শর্মার নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনার অন্যতম ফসল ‘গহন কোনো বনের ধারে’। এই গ্রন্থের পটভূমি বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল। লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় আন্তর্জাতিক শৈবাল বিজ্ঞানী অধ্যাপক এ কে এম নুরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর প্রেরণাতেই শৈবাল সংগ্রহে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকায়। সেইসব বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিশুদের জন্য কিছু একটা লেখার কথা ভাবতে থাকেন। কিন্তু বেশি দূর আগায় না। মস্কো-প্রবাসে আবুল মোমেনই তার এই ভাবনাকে উস্কে দেন। শুরু হয় পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তার প্রস্তুতিও যথেষ্ট গবেষণাসাধ্য। অনেক বই-পুস্তক, জার্নাল ঘাঁটাঘাটি করেন। এই কল্প-গল্পের মূল নায়কের মডেল খোঁজেন। কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে তৈরি হয় নায়ক তজব তরফদার। তিনি প্রতিদিনই নানান জটিল তত্ত্ব নিয়ে লেখকের কাছে হাজির হন। তার হাতে থাকে একটি চৌকা বাক্স। তার বোতাম টিপেই রাজ্যের অঙ্ক কষেন তিনি। এই অঙ্ক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত চাষাবাদের নির্ভুল তথ্য দিতে পারে। এই আজব লোকটি কাজ শেষে কোথায় চলে যায় তা আর জানেন না লেখক। হঠাৎ করেই আবার হাজির হয়। তার বিশেষ কম্পিউটারে হিসাব করে সে বলে, ‘তোমাদের নিষ্ঠুরতার কারণে পৃথিবী আবার নূহর প্লাবনের মতো তলিয়ে যাবে।’ একদিন এই অদ্ভুত লোকটিকে আর খুঁজে পান না লেখক। লেখক বনে প্রবেশ করেন। সঙ্গে পরিবারের দীর্ঘদিনের সঙ্গী রোগা কপ্চে আর শোভা বুড়ো। প্রকৃতির রহস্যময়তা তাকে যেন পেয়ে বসে। যেন নানা আবিষ্কারের নেশায় ছুটে চলা। মুগ্ধ আবেশে পাখির দিকে চেয়ে থাকা, বনের নির্জনতায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবা, এভাবেই সময় গড়িয়ে যায়। প্রকৃতির বন্ধু শোভা বুড়োও একদিন অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি জমায়। এই গ্রন্থে আর আছে লেখকের অতি আদরের প্রাণীদের কথা। তার সমস্ত ভালোবাসাই যেন একাকার হয়ে আছে এখানে। ‘গহন কোনো বনের ধারে’ প্রকৃত অর্থে প্রকৃতি ও পরিবেশের এক শৈল্পিক বয়ান।
দ্বিজেন শর্মা শুধু ডারউইনবাদে বিশ্বাসীই নন, ডারউইনের ভাবশিষ্যও। এই অনুরক্তি থেকেই বিবর্তনবাদ ও অন্যান্য আবিষ্কারে তাঁর আগ্রহ ও বিশ্লেষণ প্রশংসনীয়। ডারাউইনকে আমাদের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে চান বলেই তাঁর নানা প্রসঙ্গে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন। যার অন্যতম ‘চার্লস্ ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি।’ এটি মূলত তাঁর বিখ্যাত ঙৎরমরড়হ ড়ভ ঝঢ়বপরবং গ্রন্থের সংক্ষেপণ। বিশাল কলেবরের মূল গ্রন্থ থেকে চমৎকারভাবে প্রকৃত বিষয় ছেঁকে আনা জটিল ও দুঃসাধ্য। এ ক্ষেত্রে অঙ্গহানির আশঙ্কা থাকলেও এখানে তা হয়নি। গ্রন্থে বিজ্ঞানজগতের ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রজাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ভাবনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। কিশোরপাঠ্যের কথা বিবেচনায় রেখে পাণ্ডুলিপি তৈরিতে হাত দিলেও শেষ পর্যন্ত তা বজায় রাখা সঙ্গত মনে করেননি। কারণ বিতর্কিত মতবাদ শিশুদের কচিমনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ‘ডারউইন : বিগল্-যাত্রীর ভ্রমণকথা’য় এই অভাব কিছুটা হলেও ঘুচিয়েছেন। এখানেও অসাধ্য সাধন করেছেন দ্বিজেন শর্মা। ৪৮৯ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের ঠড়ুধমব ড়ভ ঃযব ইবধমষব গ্রন্থের সারসংক্ষেপ তুলে এনেছেন মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠায়। এই গ্রন্থের মাধ্যমে ছোটরা ডারউইনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত সম্পর্কে জানতে পারবে। শুধু ভ্রমণই নয়, বৈচিত্র্যময় ভূদৃশ্যের অনবদ্য বর্ণনা এবং নানা দেশের তৎকালীন সামাজিক অবস্থার আকৃষ্টকর উপস্থাপনও বইটির অতিরিক্ত সম্পদ। বিশেষত্বের কারণে বইটি গদ্য শাখায় নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা কল্প-গল্প ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’ সত্যিই তাঁর কল্পলোকের দূরদর্শী ভাবনাকে উপস্থাপন করে। ভবিষ্যৎ শিশু এমিকে তিনি অত্যন্ত চৌকস চরিত্রে তুলে ধরেছেন। যে অল্প বয়সেও অনেক জটিল বিষয় বুঝতে পারে। এখানেও নানা বর্ণনায় প্রকৃতি এসেছে প্রবলভাবে। এছাড়াও ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’ ছোট-বড় সব বয়সী পাঠকের জন্যই আকরগ্রন্থ।
দ্বিজেন শর্মা সবসময় শিশুই থাকতে চান। এ জন্যই সাঁ-এক্সুপেরির ছোট্ট রাজকুমারের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে যাঁর দিন কাটে এবং যে শুধু স্বপ্নই দেখে। তিনিও স্বপ্ন দেখেই কাটাতে চান বাকি সময়গুলো।
লেখক : নিসর্গী